প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা, আজ এই পোস্টে দশম শ্রেণির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আশাপূর্ণা দেবী রচিত "জ্ঞানচক্ষু" গল্পের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ৫ নম্বরের রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর দেওয়া হল। এই উত্তরগুলি তোমরা যদি মুখস্ত করতে পারো তাহলে কোনো পরীক্ষক ৫ নম্বরের মধ্যে ৫ না দিয়ে পারবেন না। প্রশ্নোত্তর গুলি খুব সুন্দর ভাবে লেখা , যা একেবারে মৌলিক ও স্বতন্ত্র।
শ্রেণি :- দশম শ্রেণি
বিষয় :- বাংলা
অধ্যায় :- জ্ঞানচক্ষু
রচয়িতা :- আশাপূর্ণা দেবী
মূলগ্রন্থের নাম :- কুমকুম
১) "জ্ঞানচক্ষু" গল্পের নামকরণ সার্থকতা বিচার করো।
উত্তর :- সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ নামকরণের মধ্য দিয়েই পাঠকেরা সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং নামের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের ব্যঞ্জনা আভাষিত হয়। আমাদের আলোচ্য ছোট গল্পটির নাম "জ্ঞানচক্ষু"।
নামটি ব্যঞ্জনধর্মী নামকরণের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। 'জ্ঞানচক্ষু' শব্দের অর্থ - বোধোদয় বা প্রকৃত জ্ঞানের উন্মেষ। অর্থাৎ এই চক্ষু এমন এক মানসিক ইন্দ্রিয় যার দ্বারা জ্ঞানকে উপলব্ধি করা যায়।
আশাপূর্ণা দেবীর "জ্ঞানচক্ষু" গল্পে প্রধান চরিত্র তপন সে মনে করত লেখকরা অন্য গ্রহের জীব, অপার্থিব কোন স্বত্তা। কিন্তু নিজের মেসোর লেখক পরিচয় পাওয়ার পর এবং তাঁর হাবভাব আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এবং সে উপলব্ধি করেছিল তার জ্ঞানচক্ষুর উন্মিলন ঘটেছে। কিন্তু জ্ঞানচক্ষু উন্মিলনে আরও বড় কারণ যে তার জন্য অপেক্ষা করছে তা সে বুঝতে পারেনি। ঘটনাক্রমে স্কুল জীবনের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে তপন একটা গল্প লিখে ফেলে। মাসির অনুরোধে মেসো তা 'সন্ধ্যাতারা' পত্রিকায় প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন এবং প্রকাশিত হয়। মেসো অবশ্য বলেছিলেন যে কচি হাতের লেখা তাই একটু কারেকশন করা দরকার। ঘটনা ক্রমে পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পটি পাঠ করতে গিয়ে তপন দেখে যে মেসো শুধু পাকা হাতে কারেকশন নয়, সম্পূর্ণ গল্পটাই পাল্টে দিয়েছেন। নিজের ব্যর্থতায় আর মেসোর বদান্যতাই অভিমানে তপন কেঁদে ফেলে এবং সংকল্প করে যদি কোনোদিন তার লেখা ছাপাতে হয় তাহলে সে নিজে গিয়ে ছাপাখানায় দিয়ে আসবে।
এখানেই তপনের দ্বিতীয় বার জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটেছে। যা নিজের নয়, সে তার দাম পেতে চাইনি। এই আত্ম উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত মৌলিকতাই গল্পটি পরিণতি লাভ করেছে। তাই গল্পের ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ "জ্ঞানচক্ষু" যথাযথ, সঙ্গত ও সার্থক।
২) জ্ঞানচক্ষু গল্পে তপনের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।
উত্তর :- বিখ্যাত মহিলা কথাসাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীর "কুমকুম" গল্পের অন্তর্গত "জ্ঞানচক্ষু" গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র স্কুল পড়ুয়া তপন। তাকে ঘিরেই বিশেষ করে তার লেখা গল্পকে কেন্দ্র করে যাবতীয় ঘটনার আবর্তন। আলোচ্য গল্পে তার চরিত্রের বেশ কতগুলি দিক ফুটে উঠেছে। যেমন -
অজ্ঞতা :- নিতান্ত অনভিজ্ঞতার কারণেই তপন বিশ্বাস করে যে যারা গল্প বা উপন্যাস লেখেন তারা পৃথিবীতে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ নন। তাই অজ্ঞ তপন যখন শুনলো তার মেসো একজন লেখক তখন তার জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হলো।
শ্রদ্ধাশীল :- তপন তার কাজের প্রতি ও গুরুজনদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। এমনকি পড়াশোনার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিল বলে সে হোমটাস্কের খাতা আনতে ভোলেনি। মেসোমশাইকে সে যেমন ভক্তি - শ্রদ্ধা করে তেমনি অন্যদের প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল।
কল্পনাপ্রবণতা :- তপন কল্পনাপ্রবণ। তার কৈশোর মনের রঙ্গিন কল্পনায় সে বিশ্বাস করে লেখকরা আকাশ থেকে পড়া কোন অদ্ভুত জীব।
নিজস্বতা :- তপনের চরিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক তার নিজের প্রতি গভীর বিশ্বাস তথা নিজস্বতা। এই বয়সে যখন সবাই রাজা-রানী, ভূত-পেত নিয়ে গল্প লিখতে ব্যস্ত সেখানে তপন যে গল্প লিখেছেন তা সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব অভিজ্ঞতার রসে সঞ্চিত।
দৃঢ়তা :- মায়ের প্রচ্ছন্ন আস্থা, নতুন মেসোর প্রশংসা সত্বেও তার লেখার ওপর কলম চালানো নিয়ে বাড়ির সদস্যদের ঠাট্টা তামাশায় তপন বিমর্ষ হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি।
আত্মমর্যাদা সম্পন্ন :- তপনের আত্মমর্যাদাবোধ প্রবল। যখন সে দেখে তার নিজস্ব গল্পটি উধাও, ব্যথিত চিত্তে সে সংকল্প করে - "যদি কখনো লেখা ছাপতে দেয় তো, তপন নিজে গিয়ে দেবে। নিজের কাঁচা লেখা। ছাপা হয় হোক, না হয় না হোক।"
সৃজনশীল :- গল্প লেখার মধ্য দিয়ে তপনের সৃজনশীল মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই সকলের আড়ালে একাসনে বসে সে একটা গল্প লিখে ফেলে।
সব মিলিয়ে সৃষ্টির উত্তেজনায়, মেকি সাফল্যের প্রত্যাখ্যানে এবং জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলনে তপন পরিচিত সমাজের এক ব্যতিক্রমী চরিত্র।
৩) "আজ যেন তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন" - কোন দিনের কথা বলা হয়েছে? সেটি কেন বক্তার কাছে সবচেয়ে দুঃখের দিন? ১+৪=৫
উত্তর :- আশাপূর্ণা দেবীর "জ্ঞানচক্ষু" গল্পে 'আজ' বলতে সেই দিনের কথা বলা হয়েছে যেদিন তপনের ছোটমেসো "সন্ধ্যাতারা" পত্রিকায় তপনের লেখা গল্পটি প্রকাশ করে তপনদের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন।
∆ নতুন মেসোমশাই তপনের কথা রেখেছেন। তপনের লেখা প্রথম গল্পটি সত্যি সত্যি তিনি ছেপে এনেছেন "সন্ধ্যাতারা" পত্রিকায়। তপনের কাছে ব্যাপারটি যেমন বিস্ময়কর, অলৌকিক তেমনই আনন্দদায়ক। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে একদিন ছোটমেসো মাসিকে সঙ্গে নিয়ে তপনদের বাড়িতে হাজির হয় তপনের প্রকাশিত গল্প নিয়ে। এই উপলক্ষে বাড়িতে শোরগোল পড়ে যায়। মেসোর দ্বারা গল্পের কারেকশন ও তাঁর মাহাত্ম্যের কথা জোরালোভাবে চর্চিত হতে থাকে। অবশেষে মায়ের আদেশে গল্পটা পাঠ করতে গিয়ে জোর ধাক্কা খায় তপন। পড়তে গিয়ে দেখে শিরোনাম ছাড়া মেসো সবকিছুই যেন পাল্টে দিয়েছেন। তপন বোবার মত চুপ করে যায় কারণ কোথাও কোনো নিজস্বতার ছাপ নেই। থমকে দাঁড়িয়ে যায় তপন - অবশেষে ধমক খেয়ে পড়তে শুরু করলেও মাথায় কিছু ঢোকে না। চারিদিকে ধন্যি ধন্যি রব উঠে - "মেসোমশাই গল্পটা ছাপিয়ে দিয়েছে।"
তপনের গল্পে তপন নেই - এটাই সবচেয়ে দুঃখের বিষয়। যেদিনের অপেক্ষায় তখন এতগুলি দিন অপেক্ষায় ছিল সেই দিনের অবসান ঘটলো ঠিকই কিন্তু চোখের কোণ যেন ভারী হয়ে এলো, বলার ভাষা যেন গেল হারিয়ে। এ যেন তার চরম অপমান, তার অন্তর বেদনা তাকে দুমড়ে মুচড়ে দিল। তাই আজ তপনের সবচেয়ে দুঃখের দিন।
৪) "জ্ঞানচক্ষু" গল্প অবলম্বনে নতুন মেসোর চরিত্র আলোচনা করো।
উত্তর :- কথাশিল্পী আশাপূর্ণা দেবী রচিত "জ্ঞানচক্ষু" গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তপনের আত্মোপলব্ধির পিছনে যে চরিত্রটির প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে, তিনি হলেন তপনের নতুন মেসো। আলোচ্য গল্পে মেসোমশাই চরিত্রটি আমাদের চেনা জীবনের অতি চেনা এক মানুষ। লেখিকার তুলির আঁচড়ে ছোট মেসোর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুলি ফুটে উঠেছে তা নিম্নরূপ -
প্রাথমিক পরিচয় :- প্রাথমিক পরিচয় তিনি একটি কলেজের অধ্যাপক এবং একজন স্বনামধন্য লেখক। তাঁর অনেক বই ছাপা হয়েছে। সম্পর্কে তিনি তপনের ছোট মাসির স্বামী।
সাধারণ মানুষ :- তপনের ছোটমেসো একজন বিখ্যাত লেখক হলেও সহজ-সরল সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তিনি সবার মত দাড়ি কাঁটা, সিগারেট খাওয়া, চান করা, ঘুমানো, খবরে কাগজ পড়তে গিয়ে তর্ক করা, সিনেমা দেখা, বেড়াতে যাওয়া প্রভৃতি কাজগুলি করে থাকেন।
নিরহংকারী :- তপনের মেসো একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হয়েও নিরহংকারী। তিনি কচিকাঁচা হবু লেখকদের অবজ্ঞা করেন না বরং উৎসাহিত করেন।
দূরদৃষ্টি সম্পন্ন :- তপনের লেখক মেসোমশাই কলেজের অধ্যাপক। তিনি লেখক এবং রচনার যথার্থ সমঝদার। তিনি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ বলেই তপনের লেখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রশংসা না করে পারেন না।
প্রতিশ্রুতি পালনে তৎপর :- তপনের ছোটমাসি আবদার করে তার লেখক স্বামীকে তপনের লেখাটি প্রকাশ করে দিতে বলে। ছোটোমেসো তপনের লেখার তারিফ করে বলেন গল্পটি ছাপিয়ে দেবেন। নতুন মেসো তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত পালন করেছেন।
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও স্বল্পবাক :- নতুন মেশোমশাই বেশি কথা বলেন না। আবার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়ায় যতটুকু কথা বলেন তা কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না। তিনি নিজেই বলেন - "আমি বললে সন্ধ্যাতারার সম্পাদক না করতে পারবে না।"
মিশুকে ও ফুর্তিবাজ :- ছোটমেসো একজন ফুর্তিবাজ ও মিশুকে মানুষ। লেখক সত্তার গাম্ভীর্য তাঁর মধ্যে নেই। তিনি সকলের সঙ্গে নির্দ্বিধায় খোলামেলা মিশতে পারেন, চুটিয়ে গল্প করেন, তর্ক করেন, শেষে এদেশের কিছু হবে না বলে সিনেমা দেখতে চলে যান।
অহমিকাবোধ:- মেসোর সহজ, মিশুকে মানসিকতার অন্তরালে প্রচ্ছন্ন একটি অহমিকাবোধ ছিল। এছাড়া তাঁর মধ্যে নিজেকে জাহির করারও একটা প্রবণতা আছে। তপনের লেখা গল্পটা পত্রিকায় প্রকাশের আগে 'একটু কারেকশন' যে তিনি করে দিয়েছেন তা উল্লেখ করতে তিনি ভোলেননি।
পরিশেষে বলা যায় যে, ছোট মেসো একজন অধ্যাপক ও লেখক হলেও তাঁর উপলব্ধির দৈনতা পাঠককে পীড়া দেয়। কারেকশনের নামে তপনের লেখা গল্পটি পুরোপুরি বদলে দেওয়ায় তপনের লেখকসত্তা যে এতে আহত হয়েছে
তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন