মাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর
(Madhyamik History Question and Answer))
উত্তর - ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব ( ১৯৪৭ - ১৯৬৪ ) ; ( অষ্টম অধ্যায় ) Madhyamik History Question and Answer ( 8th Chapter )
মাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর : উত্তর - ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব; (১৯৪৭ - ১৯৬৪) ( অষ্টম অধ্যায় ) Madhyamik History Question and Answer : মাধ্যমিক ইতিহাস –উত্তর - ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪) ; ( অষ্টম অধ্যায় ) :- অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যামূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর ও বিশ্লেষণমূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর | Madhyamik History 8th Chapter Question and Answer নিচে দেওয়া হলো।
এই দশম শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – WBBSE Class 10 History Question and Answer, Suggestion, Notes – উত্তর - ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব ( ১৯৪৭-১৯৬৪ ) থেকে এই ৮ নম্বরের এবং ৪ নম্বরের প্রশ্নগুলো আগামী ( West Bengal Class 10th ( X )History Examination ) – পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক ইতিহাস পরীক্ষার জন্য খুব ইম্পর্টেন্ট।
আগামী মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য Rajesh Sir Tutorial এর এই প্রশ্নোত্তর গুলি অতি অবশ্যই অনুশীলন করবে। এই প্রশ্নোত্তর গুলি একান্তভাবে মৌলিক এবং স্বতন্ত্র। কোন রেফারেন্স বইয়ের লেখা থেকে এই নোটসগুলো লিখলে পরীক্ষক কোন অনেক বেশি নম্বর দেবেন, এই আশা রাখি।
মাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর
( Madhyamik History Question and Answer))
উত্তর - ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭-১৯৬৪ ) Madhyamik History Question and Answer ( 8th Chapter ).
প্রশ্ন ১ :- ১৯৪৭ - এর দেশভাগের পর ভারতে কি কি সমস্যা দেখা দিয়েছিল?
উত্তর :- ভারতের স্বাধীনতা আইন ( ১৯৪৭ ) অনুসারে ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। শুরু হয় ঔপনিবেশিক যুগের পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে ভারতের পদযাত্রা। নবগঠিত এই ভারতকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন -
i ) দেশত্যাগ :- দেশভাগের পর মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের হিন্দু, শিখ প্রভৃতি ধর্মাবলম্বী মানুষ পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে আসে এবং ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ দেশ ত্যাগ করে ওপারে চলে যায়।
ii ) উদ্বাস্তু সমস্যা :- পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখরা ভারতে আশ্রয় নেয়। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা ভারত সরকারের সামনে কঠিন হয়ে পড়ে।
iii ) দেশীয় রাজ্য সমস্যা :- ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় কালে প্রায় ৬০০টি দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। এগুলি ভারত ডোমিনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে ভারতকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
iv ) সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা :- ভারতের স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই শুরু হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এই দাঙ্গা স্বাধীনতা লাভের পর চরম আকার ধারণ করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়।
v ) কৃষি উৎপাদন ব্যাহত :- দেশভাগের ফলে ভারতের বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। ফলে ভারতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয় ও দেশে খাদ্যাভাব দেখা যায়।
vi ) সম্পদ হ্রাস :- দেশভাগের পরে ভারতের অর্থ, সম্পদ ও সামরিক শক্তির একটি বড় অংশ পাকিস্তানের দিকে চলে যায়। ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
vii ) শিল্পে কাঁচামালের অভাব :- ভারতের পাট, তুলা প্রভৃতি কাঁচামাল উৎপাদন অঞ্চলের একটা বড় অংশ পাকিস্তানের ভাগে চলে যায় এবং এর ফলে শিল্পে কাঁচামালের অভাব দেখা যায়।
প্রশ্ন ২ :- টিকা লেখো - জুনাগড় সমস্যা।
উত্তর :- ১৯৪৭ - এ স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারতে যোগদান করলেও কয়েকটি রাজ্য ভারতে যোগ দিতে অস্বীকার করে। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল তাঁতিয়াগড় উপদ্বীপে অবস্থিত জুনাগড়।
জুনাগড় রাজ্যের নবাব ছিলেন মুসলিম, কিন্তু তাঁর ৮০ শতাংশ প্রজা ছিল হিন্দু। ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট জুনাগড়ের নবাব পাকিস্তানের যোগদানের সিদ্ধান্ত নিলে সারা রাজ্যে প্রবল গণ বিক্ষোভ দেখা দেয়। জুনাগড়ের নবাবের দেওয়ান ছিলেন শাহান ওয়াজ ভুট্টো। তিনি মুসলিম লীগের উগ্র সমর্থক ছিলেন। তার প্রভাবেই নবাব মুসলিম লীগের পক্ষ নিয়েছিলেন।
সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই জুনাগড় রাজ্যের হিন্দু প্রজারা প্রবল বিক্ষোভ দেখায়। রাজ্যের বাইরে কংগ্রেস নেতৃত্ব আন্দোলন শুরু করেন। অন্যান্য দেশীয় রাজ্যগুলি, যারা ইতিমধ্যে ভারতে যোগ দিয়েছিল, তারাও ভারত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এই সময় বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী জুনাগরে প্রবেশ করে এবং নবাব সপরিবারে পাকিস্তানে পালিয়ে যান।
জুনাগড়ের বাসিন্দারা ভারত না পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে আগ্রহী, তা জানার জন্য সেখানে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে গণভোট নেওয়া হয়। সেই সময় সেখানকার মানুষ ভারতে যোগদানের পক্ষে মত দেয়। এভাবেই জুনাগড় রাজ্যের ভারত - ভুক্তি ঘটে।
প্রশ্ন ৩ :- টীকা লেখো : কাশ্মীর সমস্যা।
উত্তর :- দেশীয় রাজ্য হিসেবে কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
কাশ্মীর সমস্যার সূচনা :- ভারতের উত্তরে অবস্থিত রাজ্যটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা মুসলিম হলেও মহারাজা হরি সিং ছিলেন হিন্দু। ভারতের স্বাধীনতা প্রাককালে লর্ড মাউন্টব্যাটেন কাশ্মীরের তৎকালীন শাসক হরি সিং কে ভারত বা পাকিস্তানের যেকোনো একটি রাষ্ট্রে যোগদান করার পরামর্শ দেন।। কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দল "ন্যাশনাল কনফারেন্স" - এর সভাপতি শেখ আব্দুল্লাহ কাশ্মীরের ভারত মুক্তির পক্ষে জনমত গঠন করলেও মহারাজা হরি সিং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কাশ্মীরের পক্ষে ছিলেন।
পাকিস্তানের কাশ্মীর আক্রমণ :- ১৯৪৭ এর ২২ শে অক্টোবর পাক মদতপুষ্ট হানাদার বাহিনী কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে এবং ব্যাপক হত্যা ও লুন্ঠন চালাতে থাকে। এসময় পাক সেনাবাহিনী রাজধানী শ্রীনগরের ৪০ মাইলের মধ্যে এসে পৌঁছায়। এই অবস্থায় মহারাজা হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার জানিয়ে দেয় - হরি সিং ভারত ভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করলে তবেই ভারত সেনা পাঠাবে।
কাশ্মীরের ভারত ভুক্তি ও ভারতীয় সেনার অভিযান :- এই পরিস্থিতিতে এক রকম বাধ্য হয়ে হরি সিং ভারত ভুক্তির দলিলে সই করেন। ২৭ শে অক্টোবর প্রায় ১০০ টি বিমানে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে অবতরণ করে এবং হানাদারদের বিতাড়িত করে দুই - তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড উদ্ধার করে। শেখ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মীরে আপৎকালীন শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
জাতিপুঞ্জের ভূমিকা :- পাকিস্তান কাশ্মীরের এক - তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড জোর করে দখল করে, যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত। এই পরিস্থিতিতে জাতিপুঞ্জ কাশ্মীরে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে লাইন অফ কন্ট্রোল ( LOC ) তৈরি করেন। ফলে সীমারেখার এপারের অংশ ভারতের দখলে থাকলেও ওপারের অংশ পাকিস্তানের দখলে চলে যায়, যে সমস্যার সমাধান আজও হয়নি।
প্রশ্ন ৪ :- স্বাধীনতা লাভের পর দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে ভারত কিরূপ নীতি বা উদ্যোগ নিয়েছিল?
উত্তর :- ভারতে স্বাধীনতা লাভের প্রাক মুহূর্তে দেশীয় রাজ্যের সমস্যা ছিল প্রায় ৫৫০ এর অধিক। এছাড়াও পোর্তুগাল ও ফ্রান্সের বেশ কিছু উপনিবেশ ভারতে ছিল। এইসব রাজ্য গুলি ছিল সমগ্র ভারত ভূখণ্ডের প্রায় ৪৮ %। স্বাধীনতা লাভের পর ভারত এই সমস্ত স্থানকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। যেমন -
কংগ্রেসের ভূমিকা :- স্বাধীনতার পর জাতীয় কংগ্রেস চেয়েছিল দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতে যোগদান করে এক অখন্ড ভারত গড়ে উঠুক। গান্ধীজি জানিয়ে দেন, কোন রাজ্য এককভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তার কাজকে স্বাধীন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য বলে গণ্য করা হবে।
বল্লভ ভাই প্যাটেলের ভূমিকা :- ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ও তাঁর স্বরাষ্ট্র সচিব ভি পি মেনন রাজ্যগুলিকে ভারত ভুক্তির জন্য "ভারত ভুক্তির দলিল" তৈরি করেন। দেশীয় রাজাদের বিপুল পরিমাণে ভাতা, খেতাব ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে একের পর এক রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন। কোথাও কোথাও আবার কূটনীতি এবং কঠোর দমন নীতিও গ্রহণ করেন।
ভারত ভুক্তি :- বল্লভ ভাই প্যাটেলের কূটনৈতিক চাপ ও হুমকির ফলে ভারত স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ দেশীয় রাজা ভারত ভক্তির দলিলে স্বাক্ষর করেন। হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় ও কাশ্মীর যোগদানে অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত যোগদানে বাধ্য হয়।
অন্যান্য উপনিবেশ :- ভারতের চাপে চন্দননগর, মাহে, পন্ডিচেরি প্রভৃতি ফরাসি উপনিবেশ সহজে যোগদান করলেও পোর্তুগিজ উপনিবেশ গুলি যেমন - গোয়া, দমন ও দিউ, নগর হাভেলী প্রভৃতি বিদেশী সাহায্যের আশ্রয়ে বিপত্তি তৈরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কূটনীতি ও দমননীতির সার্থক মিশ্রণে পোর্তুগিজ উপনিবেশ গুলিও ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রশ্ন ৫ :- দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের ভূমিকা আলোচনা করো।
উত্তর :- ভারতের ভৌগোলিক অখন্ডতা, জাতীয় ঐক্য এবং দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে ভারতের লৌহ মানব সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ছিলেন মূল কান্ডারী। প্যাটেল দেশীয় রাজন্যবর্গ কে বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ - এই তিনটি বিষয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আবেদন জানান।
বল্লভ ভাই প্যাটেলের ভূমিকা :- দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নানান পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যেমন -
i ) কঠোর মনোভাব :- ভারতীয় ভৌগোলিক সীমানায় অবস্থিত দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতে যোগদানে বাধ্য করতে প্যাটেল কঠোর ও অনমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেন।
ii ) কূটনৈতিক চাপ :- প্যাটেল স্বরাষ্ট্র সচিব ভি. পি মেননের পরামর্শে কূটনৈতিক নীতি প্রয়োগ করেন। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমরা দ্রুততার সঙ্গে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা দেশীয় রাজ্যগুলির দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।
iii ) সামরিক হুমকি :- সর্দার প্যাটেল কোন কোন দেশীয় রাজ্যকে সামরিক অভিযানের ভয় দেখিয়ে ভারতে যোগদানে বাধ্য করেন।
iv ) সুবিধা ঘোষণা :- দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনি প্রচুর ভাতা, খেতাব ও বিশেষ সুবিধার কথা ঘোষণা করেন।
v ) ভারত ভুক্তির দলিল :- দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তির জন্য Instrument of Accession বা ভারত ভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করার ব্যবস্থা করা হয়।
যে মুহূর্তে ভারতের ঐক্য বিপন্ন হতে চলেছিল, সেই মুহূর্তেই সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের সুনিশ্চিত কার্যকলাপ ও সিদ্ধান্ত ভারতের অখন্ডতাকে সুনিশ্চিত করেছিল। তাই সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলকে "ভারতীয় ঐক্যের প্রকৃত স্থপতি" বলা যায়। জার্মানি ঐক্য আন্দোলনে বিসমার্কের অবদানকে স্মরণে রেখে কেউ কেউ সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলকে বিসমার্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
প্রশ্ন ৬ :- মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব বা মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা কি?
উত্তর :- ১৯৪৭ এর ৩ রা জুন ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনের পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তাঁর এই পরিকল্পনা 'মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব' বা 'মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ' নামে পরিচিত।
মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব :- জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর মাউন্টব্যাটেন যে প্রস্তাব ঘোষণা করেন, তা হল -
i ) সমগ্র ভারতকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করা হবে। এই দুটি রাষ্ট্রই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করতে পারবে।
ii ) পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে মুসলিম প্রধান অঞ্চল অর্থাৎ সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা নিয়ে।
iii ) দেশীয় রাজ্যগুলি ইচ্ছে করলে যে কোন রাষ্ট্রে যোগ দিতে পারবে এবং নিজ নিজ সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করতে পারবে।
iv ) ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রই গণপরিষদের মাধ্যমে নিজে নিজে দেশের জন্য সংবিধান রচনা করবে।
মাউন্টব্যাটেন এও প্রতিশ্রুতি দেন যে, ভারতে যোগদানকারী দেশীয় রাজ্যগুলির নেতাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করবেন। কারণ ১৯৪৮ পর্যন্ত তিনি ভারতে কর্মরত থাকবেন।
প্রশ্ন ৭ :- আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় কিভাবে দেশভাগের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় তা আলোচনা করো।
উত্তর :- দেশভাগ সম্পর্কিত ইতিহাস চর্চায় আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা কে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেকোনো জাতির সাহিত্যে সেই জাতির জাতীয় জীবনের নানান ঘটনাবলীর পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৪৭ - এর দেশ ভাগের ফলে বাঙালির জাতিসত্তার বিভাজন, দাঙ্গা, দেশত্যাগ, উদ্বাস্তু জীবনের দুর্দশা প্রভৃতি নানান ঘটনা বিভিন্ন আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় আলোচিত হয়েছে।
দেশভাগের ব্যথা - বেদনার প্রতিফলন :- স্মৃতিকথা এবং আত্মজীবনীর মধ্য দিয়ে দেশভাগের ব্যথা - বেদনার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। দেশভাগের যন্ত্রণা মানুষকে যে নানা ভাবে পীড়া দেয় তার অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে আত্মজীবনী এবং স্মৃতিকথায়। পাঞ্জাব অঞ্চলের স্মৃতিকথায় অনেক বেশি রয়েছে প্রত্যক্ষ দাঙ্গা, হিংস্রতা এবং মৃত্যুর বিবরণ। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে দেখা যায় একটা আতঙ্ক ও দেশ ত্যাগের যন্ত্রণা।
দেশ পরিত্যাগের স্মৃতি :- হিংসা ও অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসে উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা বা এদেশে জমি বাড়ি কিনে নতুন করে বসবাস শুরু করার কথা বা জীবন সংগ্রামের কথা জানা যায়।
কয়েকটি আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা :- দক্ষিণারঞ্জন বসুর "ছেড়ে আসা গ্রাম" গ্রন্থে রয়েছে অবিভক্ত বাংলার দুই সম্প্রদায়ের ঐক্য ও সংহতির কথা, তেমনি রয়েছে দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা। দেশভাগের উপর লেখা এই ধরনের কিছু গ্রন্থ হলো -
i ) নীরদ চন্দ্র চৌধুরী রচিত গ্রন্থ "অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান"।
ii ) জ্যোতির্ময়ী দেবীর লেখা "এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা"।
iii ) চৌধুরী খালিজুজামান এর লেখা "পাথওয়ে টু পাকিস্তান"।
iv ) অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের "নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে"।
v ) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "অর্ধেক জীবন"।
vi ) কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের "শিকড়ের সন্ধানে"।
vii ) খুশবন্ত সিং এর লেখা "ট্রেন টু পাকিস্তান" প্রভৃতি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত "মেঘে ঢাকা তারা", "কোমল গান্ধার" এবং "সুবর্ণরেখা" - এই তিনটি চলচ্চিত্রকে "দেশভাগের ট্রিলজি" বলা হয়।
প্রশ্ন ৮ :- টীকা লেখোঃ রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও আইন
উত্তর :- স্বাধীন ভারত কোন নীতি অনুসারে অঙ্গরাজ্য গুলির সীমানা চিহ্নিত করবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন বা S.R.C গঠন করেন।
এই কমিশন গঠিত হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ফজল আলির নেতৃত্বে। কমিশনের আরো দুই সদস্য ছিলেন কে এম পানিক্কর ও হৃদয়নাথ কুঞ্জরু।
প্রেক্ষাপট :- দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্ত হওয়ার পর ভাষা সংক্রান্ত সমস্যার সৃষ্টি হয়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিচারপতি এস. কে দা -র নেতৃত্বে "দার কমিশন" গঠিত হয়। এই কমিশন সুস্পষ্টভাবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করে। কিন্তু বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর
থাকায় এবং দক্ষিণের জনগণ প্রবল উত্তেজিত থাকায় জহরলাল নেহেরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়ার নেতৃত্বে আর একটি কমিশন গঠন করা হয়, যা "জে. ভি. পি কমিটি" নামে পরিচিত।
রাজ্য পুনর্গঠন আইন :- এই কমিশন ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তার প্রতিবেদন পেশ করে এবং 1956 তে রাজ্য পুনর্গঠন আইন পাশ হয় এই আইন অনুসারে ভারতকে ১৪ টি প্রদেশ বা রাজ্য এবং ছয়টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়।
তেলেঙ্গানাকে অন্ধপ্রদেশের সঙ্গে ও পুরুলিয়া কে পশ্চিমবঙ্গের সাথে যুক্ত করা হয়। মধ্যপ্রদেশ নামে একটি নতুন রাজ্যের গঠন করা হয়। বোম্বাই প্রদেশকে অখন্ড রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই আইনের দ্বারা ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য দৃঢ় হয়। তবে একথাও ঠিক যে রাজ্য পুনর্গঠনের মাধ্যমে ভারতে সব সমস্যার সমাধান হয়নি। ১৯৬০ সালে প্রবল আন্দোলনের চাপে বোম্বাই প্রদেশকে ভেঙ্গে দুটি পৃথক রাজ্য মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট তৈরি করা হয়।
৯) হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি কিভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়?
উত্তর :- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীন হলেও শতাধিক দেশীয় রাজ্য তখন পর্যন্ত স্বাধীন ছিল। তাই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ভারত সমস্যায় পড়ে। এরুপ একটি দেশীয় রাজ্য ছিল হায়দ্রাবাদ। শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার বলপূর্বক এ রাজ্যটিকে ভারতভুক্ত করে।
পটভূমি :- হায়দ্রাবাদ রাজ্য ছিল ভারতের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ দেশীয় রাজ্য। এখানে শাসক ছিলেন নিজাম। রাজ্যের ৮৭ শতাংশ জনগণ ছিল হিন্দু। তারা হায়দ্রাবাদকে ভারতভুক্তির পক্ষপাতী হলেও নিজাম তাঁর স্বাধীন অস্তিত্ব ধরে রাখতে হায়দ্রাবাদের জনগণ ও ভারত সরকারের আবেদনে কর্ণপাত করেনি।
হায়দ্রাবাদে বিদ্রোহ :- ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের তেলেঙ্গানার কৃষকরা নিজামের কুশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।
কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া :- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট হায়দ্রাবাদ রাজ্যে কংগ্রেস গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সত্যাগ্রহ শুরু করে। কিন্তু নিজাম সরকার ও রাজাকার বাহিনী তাদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। বাধ্য হয়ে বহু মানুষ ভারতের ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া :- এরুপ পরিস্থিতিতে ভারত সরকার তার নিরাপত্তার প্রশ্নে হায়দ্রাবাদ সরকারকে এক চরমপত্র পাঠায় এবং তাতে রাজাকার বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়ার দাবি জানানো হয়। কিন্তু নিজাম সেই দাবি অস্বীকার করলে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ১৩ ই সেপ্টেম্বর জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারত হায়দ্রাবাদ আক্রমণ করে। ১৮ সেপ্টেম্বর হায়দ্রাবাদ দখল হয়।
১০) স্বাধীনতার পর ভাষার ভিত্তিতে ভারত কিভাবে পুনর্গঠিত হয়?
উত্তর :- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীন হলেও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই সমস্যা গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের সমস্যা।
পটভূমি :- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের জন্য নানা প্রদেশে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর কারণ ছিল এই যে ভারতের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে ভাষাগত ও সংস্কৃতি গত ঐক্য গড়ে ওঠেনি।
দেশীয় রাজ্যের সংযুক্তি :- ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দেশীয় রাজ্যগুলি নানা উপায়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়, এর ফলে যে সমস্যাগুলি তৈরি হয়, তা হল -
i ) এই রাজ্যগুলির সীমানা কি হবে।
ii ) তাদের নিয়ে পৃথক রাজ্য গড়া হবে কি না।
iii ) তাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে কি না।
ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন :- এই সমস্যা গুলি সমাধানের জন্য ভারত সরকার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এস. কে ধরের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। এই কমিশন ভারতের ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিপক্ষে মত দেয়।
আন্দোলনের সূচনা :- এই ঘোষণা ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিকে আরোও সোচ্চার করে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে পত্তি শ্রীরামালু মাদ্রাজ প্রদেশে পৃথক রাজ্যের দাবিতে অনশন শুরু করে। ৫৮ দিনের মাথায় তিনি মারা যান। ফলে আন্দোলন মারাত্মক আকার ধারণ করে।
মূল্যায়ন :- শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে তেলেগু ভাষা নিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিল ভাষাভাষীদের নিয়ে তামিলনাড়ু রাজ্য গঠিত হয়। এইভাবে ভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন